স্পন্সরড এলার্ম


যাত্রাবাড়ী থেকে তিহান আর আমি বাহাদুরশাহ গাড়ীতে উঠেছি বাংলাবাজার যাওয়ার জন্য। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় দাড়িয়ে না থেকে গাড়ীতে দাড়িয়ে যাচ্ছি। এটা ছাত্র জীবনের নিয়মিত অভ্যাস। লেগুনার পিছনে বাদরের মত ঝুলে ঝুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় অনেক রয়েছে। কিন্তু বাহাদুরশাহ গাড়ীতে এত কষ্ট হবে জানলে রাস্তায় দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজাটাই উপভোগ করতাম। দয়াগঞ্জ মোড়ে যেতেই পিছন থেকে আরেকটা গাড়ী আমাদের গাড়ীকে ধাক্কা মারলো। বিকট একটা শব্দ হলো। তিহান আর আমি শক্ত করে গাড়ী ধরে দাড়িয়ে আছি কিন্তু মধ্য বয়স্ক কাকা ধপাস করে সামনের মহিলা সীটের উপর আছেড়ে পড়লো। বেচারা লজ্জা পেয়েছে। আমরা মুখ চেপে হাসতে হাসতে তাকে উঠলাম। আমাদের পাশের সীটে বসা বয়স্ক এক লোক ভয়ে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” কালিমা পড়তেছে।
বেচারা লজ্জায় লাল হয়ে উঠেতে উঠতে বললো, ওই চাচা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” পড়েন ক্যান? জানেন না এই শিরকী কালিমা!!!
আমি অবাক হয়ে তিহানের দিকে তাকালাম। তিহান আমার চেয়েও বেশী অবাক দৃষ্টিতে মধ্য বয়স্ক লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ীর সব মানুষ একবার লোকটি দিকে তাকালো। আমি লোকটিকে কিছু বলতে যাবো এর মধ্যেই তিহান আমাকে ইশারা দিয়ে থামতে বললো। এরই মধ্যে বুড়া চাচা চেঁচিয়ে বলতেছে, আপনে কি নাস্তিক নাকি? এই কালিমা না পড়লেতো মুসলিম হওয়া যায় না। শিরকী কালিমা কিভাবে হয়?
এইবার সে একটু হতভম্ব হয়ে গেল। গাড়ীর সামনেই ড্রাইভারের পাশে একটা ব্যাজ ঝুলানো। যার একপাশে আল্লাহ এবং আরেক পাশে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লিখা রয়েছে। লোকটি সেই ব্যাচের দিকে দেখিয়ে বুড়ো চাচাকে বলতেছে, ওইযে একটা ব্যাজ দেখছেন? ওটার এক পাশে আল্লাহ এবং আরেকপাশে মুহাম্মাদ নাম লিখা। পাশাপাশি লিখা নাই। ইসলামেও এভাবে পাশাপাশি লিখা এবং পড়া নিষেধ। আর তাছাড়া এই কালিমা আংটির মধ্যে লিখা ছিল, যুদ্ধের পতাকার মধ্যে লিখা ছিল। সেখানেও এভাবে উপরে নিচে লিখা ছিল। এটার কোন সহীহ হাদীস নাই যে একসাথে পড়তে হবে। আপনে বুড়া মানুষ কি বুঝবেন আর। বাপ দাদায় যেমনে যা করছে তা ই করতেছেন। জীবনেতো কিতাবাদী পড়েন নাই ।
বেচারা বুড়ো মানুষ। মুখটা গোমরা করে তিহানের দিকে তাকালো। গাড়ীর যাত্রীরাও কেমন হয়ে তাকিয়ে রইলো। তিহান এবার বললো কাকা আপনি কি কোন শায়খকে অনুসরন করেন?
– কোন শায়েখকে অনুসরন করবো? আমি একমাত্র কুরআন এবং হাদীস মান্য করি। আমি খাঁটি মুসলিম।
আমাদের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, তিনি আহলে হাদীস নামক ওহাবী জুস পান করেছে। তিহান একটু কাশি দিয়ে বলতে শুরু করলো। দেখুন আপনার মত আমিও এক সময় এরকম মনে করতাম কিন্তু যখন সহীহ হাদীস পেলাম তখন থেকে এধরনের বিশ্বাস থেকে ফিরে এসেছি।
তিহানের কথা শুনতেই বাসের যাত্রীরা এবার সকলে তিহানের দিকে তাকালো। আমিও একটু অবাক হলাম, তারপরেও শুকরিয়া আদায় করলাম, যাক অন্তত তিহান সঠিকটা বুঝতে পেরেছে। তিহান এবার বলতে শুরু করলো:
– যে সকল হাদীস ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহ:) এর শর্তানুযায়ী সহীহ ছিল। কিন্তু তারা হয়তো কোন কারণে সেই হাদীসগুলো তাদের কিতাবে উল্লেখ করেন নাই । অধিকাংশ সেই হাদীসগুলোই বিশ্ব বিখ্যাত হাফিজুল হাদীস ইমাম হাকিম নিসাপুরী (রহ:) তার কিতাবে স্থান দেন। তার কিতাবের নাম হচ্ছে, “আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন” । সেখানে তিনি একটি হাদীস শরীফ উল্লেখ করেছেন। হাদীসটির র্অথ হচ্ছ:
***আমীরুল মু’মিনীন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন আদম আলাইহিস সালামের দ্বারা ভুল বশতঃ আল্লাহর নির্দেশ ভঙ্গ হলো। তখন আদম আলাইহিস সালাম তার মাথাকে আরশের দিকে উত্তোলন করলেন এবং বললেন, হে আমার প্রভু! আমি আপনার নিকট মুহাম্মাদ ﷺ এর উসিলা দিয়ে আরজ করছি, আপনি তার উসিলায় আমাকে ক্ষমা করুন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি ওহী নাযিল করলেন, হে আদম! তুমি কিভাবে মুহাম্মাদ ﷺ কে চিনলে? আদম আলাইহিস সালাম বললেন, হে আমার প্রভু! নিশ্চয়ই যখন আপনি আমাকে সৃষ্টি করার পরে আমি আরশের দিকে আমার মাথাকে উচু করলাম এবং আমি আরশের পায়ার মধ্যে এ কথা লিখিত দেখতে পেলাম যে, لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ । তখন আমি এটা বুঝতে পারলাম যে, আপনি আপনার শ্রেষ্ঠ কোন বান্দা এর নাম ব্যাতীত অন্য কারো নাম আপনার নিজের নামের সাথে লিখে রাখবেন না। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি ওহী নাযিল করলেন, হে আদম! নিশ্চয়ই সে তোমার সন্তানদের মধ্যে সর্বশেষ নবী এবং তোমার সন্তানদের মধ্যে তার উম্মত হচ্ছে সর্বশেষ উম্মত। আর যদি আমি তাকে সৃষ্টি না করতাম, তাহলে তোমাকেও আমি সৃষ্টি করতাম না।
*** আল-মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন গ্ধ ومن كتاب آيات رسول الله صلى الله عليه وآله وسلم التي في دلائل النبوة – استغفار آدم عليه السلام بحق محمد صلى الله عليه وآله وسلم – হাদীস নং- ৪২২৮
শুধু ইমাম হাকেম ই নয়, “ইমাম ত্ববরানী (রহ:)” তার “মু’জামুল আওসাত্ব এবং মু’জামুস সগীর” এর মধ্যে, “ইমাম বায়হাক্বী (রহ:)” তার “দালায়েলুন নবুওয়াত” এর মধ্যে, “ইমাম দায়লামী (রহ:)” তার “মুসনাদিল ফেরদাউস” এর মধ্যে এবং “ইমাম ইবনে কাছীর (রহ:)” তার “আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া” এর মধ্যে সহীহ সনদে উল্লেখ করেছেন। আর তারা হাদীসখানা র্বণনা করার পরে হাদীসটিকে সহীহ বলছেনে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ টিরও অধিক কিতাবে এই হাদীস শরীফটি বণিত হয়েছে।
এরপরে ইমাম হাকমি নসিাপুরী (রহ:) আরো একটি হাদীস র্বণনা করনে:
– হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা ঈসা আলাইহিস সালাম এর প্রতি ওহী নাযিল করে বললেন, হে ঈসা তুমি মুহাম্মাদ ﷺ এর প্রতি ঈমান আন ও তোমার উম্মতদেরক আদেশ দাও তারা যেন আমার নবীকে দেখা মাত্র ঈমান আনে। কেননা, যদি মুহাম্মাদ ﷺ কে না সৃষ্টি করতাম তাহলে আমি আদম কেও সৃষ্টি করতাম না। আমি যদি মুহাম্মাদ ﷺ কে না সৃষ্টি করতাম তাহলে জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করতাম না। আর নিশ্চয়ই যখন আমি পানির উপরে আরশ সৃষ্টি করলাম তখন ইহা নড়াচড়া করছিল। অতঃপর আমি ইহার উপর লিখে দিলাম “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” ফলে আরশ থেমে গেল।
*** আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন গ্ধ ইমাম হাকিম নিসাপুরী (রহ:) গ্ধ كتاب تواريخ المتقدمين من الأنبياء والمرسلين গ্ধ ومن كتاب آيات رسول الله صلى الله عليه وآله وسلم التي في دلائل النبوة গ্ধ হাদীস নং- ৪২৮৬
এই হাদীসটি বর্ণনার পরে ইমাম হাকিম নিসাপুরী (রহ:) বলেন, هذا حديث صحيح الإسناد অর্থাৎ এই হাদীসের সনদ সহীহ।
ইমাম জালালুদ্দীন সূয়ুতী (রহ:) তার খাসায়েসুল কুবরা এবং আল্লামা নূরুদ্দিন আলী ইবনে আহমাদ সামহুদী (রহ:) তার ওয়াফাউল ওয়াফা এর মধ্যে বলেন, وأخرج الحاكم وصححه অর্থাৎ হাকিম হাদিসখানা বের করেছেন ও ইহাকে সহীহ বলে সমর্থন করেছেন।
এখানেই শেষ নয়। আপনি যেই হাদীসগুলো কে জাল বলছেন ওইগুলো মূলত হাসান থেকে দূবল সনদের হাদীস। তবে একাধিক দূবল সনদ একত্রিত হলে তা আর দূবল থাকে না। এরকম দূবল হাদীসের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয় মামা। আমার কাছে ১৮ টি দূবল সনদের হাদীস রয়েছে। যেখানে স্পষ্টভাবেই এই কালিমা একত্রে লিখা রয়েছে। ১৮ টি হাদীস একত্রিত হয়ে একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করে।
বাসের সকল যাত্রী এবার নড়েচড়ে বসলো। সকলেই মনোযোগ দিয়ে তিহানের কথা শুনছিল। আমিও পাশে দাড়িয়ে অবাক হয়ে শুনছিলাম। মধ্য বয়স্ক লোকটির মুখের দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না। আর ওই বুড়ো চাচাতো মহা খুশি হয়ে বলতেছে,
– দেখেছেন হাদীস আছে না নাই? কোন ছিঁচকা মৌলভী আপনারে পড়াইছে কে জানে।
মধ্য বয়স্কী লোকটার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হচ্ছে না। পিছন থেকে আরেক যাত্রী বলতেছে, কাকা আপনে নাকি খাঁটি মুসলিম। তাইলে এই হাদীসগুলা কি জীবনে শুনেন নাই। এ কথা শুনেই গাড়ীর সকল যাত্রী হো হো করে হেসে দিল। গাড়ীর ড্রাইভারও হাসি দিয়ে একটু তাকিয়ে আবার গাড়ী চালাতে লাগলো।
গাড়ী রায়সাহেব বাজার মোড়ে আসতেই লোকটা নেমে গেল। নামতে নামতে আমতা করে বলতে লাগলো, মিয়া কিতাব কিছু বুঝিনা দেইখা কি সব কিতাবের একটা হাদীস কইলেই হইলো? আমি বললাম, কাকা আপনি না বললেন কুরআন হাদীস ছাড়া আর কিছু মানেন না। তাইলে এই কিতাবের নামই যদি জীবনে না শুনেন তাইলে হাদীস মানেন কিভাবে। বেচারা আর পিছনের দিকে তাকালো না। গাড়ীর পিছন থেকে একযাত্রী জোড়ে আওয়াজ দিয়ে বললে ও খাটি কাকা জবাবটা দিয়া যান।
তার কথা শুনে গাড়ীর মধ্যে এবার হাসি আর থামে না।
বাংলাবাজার মোড়ে নেমে হাটঁতে হাঁটতে আমি তিহান কে বললাম, যাক তাইলে তুই সঠিকটা অবশেষে বুঝতে পারলি। তিহান একটু লজ্জা পেল।
– তাহমিদ হাসান
(2391)