স্পন্সরড এলার্ম


থ্রিজি আসছে— এ উন্মাদনায়ই কেটে যায় বছরখানেক। এর পর গত বছরের শেষ দিকে চালু হয় নতুন প্রযুক্তির সেবাটি। এজন্য বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগও করে সেলফোন অপারেটরগুলো। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই সে উন্মাদনায় ভাটা পড়েছে। থ্রিজির ব্যবসায়িক সাফল্য নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে অপারেটররা। সেবা পেতে বিড়ম্বনার অভিযোগ তুলছেন গ্রাহকও।
থ্রিজি পরিষেবার লাইসেন্স ও তরঙ্গ বরাদ্দ ফি বাবদই সেলফোন অপারেটরগুলোর খরচ হয়ে গেছে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রাথমিক অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে আরো কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর পর গত বছরের অক্টোবরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সেবাটি চালু হয়। কিন্তু ছয় মাসেও ইন্টারনেটের নতুন গ্রাহক সেভাবে সৃষ্টি করতে পারেনি কোনো অপারেটরই। ডাটাভিত্তিক সেবা থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধিতেও বড় কোনো উল্লম্ফন নেই। খাতটি থেকে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধিতে নিম্নমুখিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। উপরন্তু বিকল্প ব্যবস্থা না রেখেই থ্রিজি নেটওয়ার্ক উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণে স্বাভাবিক সেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন গ্রাহকরা।
শীর্ষ সেলফোন অপারেটর গ্রামীণফোন সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটির ডাটাভিত্তিক সেবা থেকে আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৫ শতাংশ। গত অক্টোবরে থ্রিজিসেবা চালুর পরও ২০১৩ সালে এ থেকে অপারেটরটির আয়ের প্রবৃদ্ধি মাত্র ১৭ শতাংশ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির থ্রিজিসেবার গ্রাহকসংখ্যা সাড়ে সাত লাখ, যা মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ১০ শতাংশেরও কম। যদিও দেশের সব কটি জেলায়ই থ্রিজি নেটওয়ার্ক চালু করেছে অপারেটরটি।
জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স সৈয়দ তাহমিদ আজিজুল হক বলেন, থ্রিজি প্রযুক্তির সেবা সবে চালু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার ওপর নতুন এ প্রযুক্তির প্রভাব সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারি শেষে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬১ লাখ। এর মধ্যে সেলফোন অপারেটরদের ইন্টারনেট গ্রাহক ৩ কোটি ৪৬ লাখ। যদিও থ্রিজিসেবা চালুর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এ সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪৯ লাখের বেশি। অর্থাৎ থ্রিজিসেবা চালুর পর সেলফোন অপারেটরদের ইন্টারনেটসেবার গ্রাহক না বেড়ে উল্টো কমেছে। বিপরীতে গ্রাহক বেড়েছে তারভিত্তিক ফিক্সড ইন্টারনেটসেবার।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশনের (আইএসপিএবি) সাবেক সহসভাপতি সুমন আহমেদ সাবির এ প্রসঙ্গে বলেন, মোবিলিটি প্রয়োজন, এমন ক্ষেত্রেই শুধু তারবিহীন ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে। তবে দ্রুতগতির ও বেশি ডাটা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে, এমন সব ক্ষেত্রে তারভিত্তিক ইন্টারনেটই কার্যকর। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয়ও এ মাধ্যমের ওপর নির্ভরতা এখনো বেশি। তাই থ্রিজিসেবার কারণে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের (আইএসপি) ব্যবসায় প্রভাব পড়ছে বলা যাবে না।
সেলফোন অপারেটরদের বাণিজ্যিক সাফল্য নির্ভর করে মূলত গ্রাহকসংখ্যার ওপর। ভয়েস কলনির্ভর টুজির ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক গ্রাহককে নিজেদের নেটওয়ার্কে আকর্ষণ করতে পেরেছে অপারেটরগুলো। তবে ডাটানির্ভর থ্রিজিসেবার ক্ষেত্রে সাফল্যটা সেভাবে আসছে না। খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, থ্রিজির ক্ষেত্রে গ্রাহক প্রবৃদ্ধি অনেক ধীরগতির। তাই অপারেটরদের এক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি আর্থিক ঝুঁকির মুখে পড়তে হতে পারে।
টুজি থেকে থ্রিজিতে রূপান্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে মূলত তিনটি বিষয় জড়িত। এগুলো হলো— প্রয়োজনীয় নেটওয়ার্ক অবকাঠামো তৈরি, প্রচলিত ভয়েসনির্ভর সেবা থেকে গ্রাহকদের ডাটানির্ভর সেবায় নিয়ে আসা ও এ প্রযুক্তি উপযোগী হ্যান্ডসেট সুলভে গ্রাহকদের হাতে তুলে দেয়া। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিচেনায় নিয়ে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চপ্রযুক্তির এ সেবা গ্রহণের উপযোগী হ্যান্ডসেটের মূল্য ও ডাটাভিত্তিক সেবার প্যাকেজ কেনার সামর্থ্যের বিষয়টিও গ্রাহক প্রবৃদ্ধিতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশ মোবাইল হ্যান্ডসেট ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিআইএ) সাধারণ সম্পাদক ও সিম্ফনি মোবাইলসের পরিচালক রেজওয়ানুল হক বলেন, থ্রিজিসেবার বিস্তৃতিতে অপারেটরদের প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি সুলভে স্মার্টফোন পাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এ ধরনের ডিভাইস আনা না গেলে বাধাগ্রস্ত হতে পারে থ্রিজিসেবার বিস্তার।
গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর নিলামের মাধ্যমে থ্রিজির তরঙ্গ বরাদ্দ নেয় গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল। লাইসেন্স ও তরঙ্গ বরাদ্দ বাবদ গ্রামীণফোন ১০ মেগাহার্টজের জন্য ব্যয় করে প্রায় ১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অন্য তিন অপারেটরের প্রত্যেকে ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গের জন্য ব্যয় করে ৮১৬ কোটি টাকা। এছাড়া বিদ্যমান টুজি নেটওয়ার্ক উন্নয়ন ও থ্রিজির প্রাথমিক অবকাঠামো উন্নয়নে চার সেলফোন অপারেটর গত অর্থবছর প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। এসব প্রস্তুতি শেষ করে গত বছরের ৭ অক্টোবর গ্রামীণফোন, ২১ অক্টোবর বাংলালিংক, ৩০ অক্টোবর রবি ও ৭ নভেম্বর এয়ারটেল বাণিজ্যিকভাবে এ সেবা চালু করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. ইউসুফ সরোয়ার উদ্দিন বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে তারভিত্তিক ইন্টারনেট ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা থাকবেই। মূলত মোবিলিটি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য থ্রিজির গ্রাহক হবে অনেকে। তবে এ প্রযুক্তিতে ব্যবহারোপযোগী কনটেন্ট সহজলভ্য না হলে প্রত্যাশিত মাত্রায় গ্রাহক পাওয়া সম্ভব হবে না।
থ্রিজির লাইসেন্স নেয়ার পর থেকেই ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে চার সেলফোন অপারেটর। দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়াও ফেলে এসব বিজ্ঞাপন। তবে থ্রিজি নেটওয়ার্ক উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রভাবে প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান সেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গ্রাহকরা। তারা বলছেন, নেটওয়ার্ক উন্নয়নের কাজ চলছে, এমন এলাকায় কল ড্রপসহ আরো নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের।
লাইসেন্স পাওয়ার পর রবি এরই মধ্যে ১ হাজার ৪০০-এর বেশি থ্রিজি বিটিএস স্থাপন করেছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট (করপোরেট কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া রিলেশন্স) সৈয়দ তালাত কামাল। তিনি বলেন, দ্রুত নেটওয়ার্ক উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রাহকদের উন্নত সেবাদানের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে রবি। প্রতিদিনই থ্রিজিসেবার গ্রাহক বাড়ছে। ফলে থ্রিজি থেকে রবির আয়ও বাড়ছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বের অনেক দেশেই থ্রিজি থেকে প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি অপারেটররা। বিনিয়োগের তুলনায় এ প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ নয়। ফলে বিদ্যমান টুজি নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই উন্নততর সেবা নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। দেশেও থ্রিজি চালুর পর একই ধরনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো।
(1724)