স্পন্সরড এলার্ম


গোপনে মানুষকে সাহায্য করা, কোন মজলিসে নিজেকে জাহির করা থেকে বিরত থাকা, অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ না করা এবং কারো সামনে তার প্রশংসা না করার মত উত্তম চরিত্র সূফীদের জীবনের সাথে মিশে আছে।
তারা সর্বদাই রাতের আঁধারে মানুষকে সাহায্য করতে পছন্দ করতেন। তবে প্রকাশ্যেও করতেন কিন্তু গোপনকে তারা অধিক গুরুত্ব দিতেন। যথাসম্ভব মজলিস এড়িয়ে চলতেন কিন্তু কোন কারণে মজলিসে যাওয়া দরকার হলে তারা নিজেকে কখনো জাহির করতেন না। কেননা এই দুইটা বিষয় মনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে।
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন “যারা তাদের সম্পদ দিন-রাত প্রকাশ্যে, গোপনে আল্লাহর পথে খরচ করে। তাদের পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের কাছে রাখা আছে। তাদের কোনো ভয় নেই, তারা কোনো আফসোস করবে না। [আল-বাক্বারাহ ২৭৪]”
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ্য দান করার চেয়ে গোপনে দান করাকে বেশি উত্তম বলেছেন।
“যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতইনা উত্তম। আর যদি খয়রাত গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্যে আরও উত্তম। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের কিছু গোনাহ দূর করে দিবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজ কর্মের খুব খবর রাখেন।” [আল-বাক্বারাহ ২৭১]
গোপন দান করার ব্যাপারে অনেক হাদীস রয়েছে:-
হযরত আবু হুরায়রা রদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন আল্লাহর ছায়া ব্যতিত কোনো ছায়া থাকবে না, তখন আল্লাহ তায়ালা সাত শ্রেণির লোককে তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন। (তাদের মধ্যে একজন হলো) যে ব্যক্তি এতো গোপনে সাদকাহ বা দান করে যে, ডান হাত যা দান করে, বাম হাত তা টের পায় না।’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ)
আমাদের সমাজে এমন মানুষের খুব অভাব যারা নিজেকে জাহির করতে পছন্দ করেন না। অথচ এটা মারাত্মক একটি অহংকারের বহিঃপ্রকাশ। কিছু মানুষ তারা মজলিসে আগ বাড়িয়ে কথা টেনে নিয়ে কথা বলে, আবার কিছু মানুষ সর্বদা নিজের কথাকেই সবার উপরে প্রাধান্য দেয়োর জন্য কথা বলে যায়, বর্তমানে বিশেষ করে ফেইসবুকে মানুষ একটা হাদীস অথবা উপদেশ মূলক বানী বা অন্য কোন হাদীস বা কুরআনের আয়াত শেয়ার করলেও নিজের চেহারার ছবি বড় করে দিয়ে দেয়। এটাও মারাত্মক ধরনের অহংকার এবং লৌকিকতার প্রকাশ। যা ধীরে ধীরে মানুষকে হক্ব থেকে দূরে নিয়ে যায়।
অথচ সূফীগণ সর্বদা নিজেকে ছোট মনে করেছেন। তারা মনে করতেন, তিনিই সবচেয়ে খারাপ লোক, তাই তারা নিজের চেহারা লোক সম্মুখে আগ বাড়িয়ে উন্মোচন করতে লজ্জাবোধ করতেন। মজলিসে চুপ করে এক কোণায় বসে থাকতেন। মজলিস শেষ হলে ভীড়ের মধ্যেই চলে যেতেন, যাতে কেউ খেয়াল না করে।
হজরত লোকমান (আ.) তার সন্তানকে বলেন, ‘হে বৎস! তুমি এ জন্য জ্ঞানার্জন করো না যে তুমি জ্ঞানীদের সাথে অহংকার করবে কিংবা মূর্খদের ওপর নিজেকে জাহির করবে অথবা বিভিন্ন মজলিসে নিজেকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করবে। তুমি জ্ঞানকে উদাসীনতায় পরিত্যাগ করো না বা মূর্খতার মাঝে নিক্ষেপ করো না। হে বৎস! তুমি আপন চোখ দিয়ে দ্বীনী মজলিস বাছাই করে নাও। যখন কোনো দলকে আল্লাহর স্মরণ করতে দেখবে তখন তাদের সাথে যোগ দিবে। (দীর্ঘ হাদীসের কিয়দাংশ) [মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ১৬৫১]
অহংকারের ব্যাপারে বলার দরকার আছে বলে মনে করি না। নিজেকে জাহির করাও এক ধরনের অহংকার শুধু এতটুকুর দলীল উপস্থাপন করা হলো। ইবলিস নিজেকে জাহির করেছিল। বলেছিল, সে আগুনের আর আদম মাটির। মাটি থেকে আগুন উত্তম। সে নিজেকে এভাবে জাহির করার মাধ্যমেই তার চূড়ান্ত অহংকার প্রকাশ পেয়েছিল। যার জন্য তার পরিণাম হয়েছে জাহান্নাম।
লোভ সম্পর্কে বলার অপেক্ষা রাখে না। নতুন করে বলার কিছুই নেই। কিন্তু এমন কিছু লোভ রয়েছে যা ব্যক্তির সাথে দ্বীন ইসলামেরও ক্ষতি করে। অর্থাৎ সম্মানের লোভ করা। নিজেকে সম্মানিত করার চিন্তা করাও এক ধরনের লোভ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘ ছাগলের পালে ছেড়ে দিলে যে রকম ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, সম্মান লিপ্সা ও সম্পদের লোভ মানুষের দ্বীনের জন্য তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর।’ (সুনান তিরমিজি)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন “ঈমান ও লোভ এক অন্তরে একত্র হতে পারে না। এর কারণ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কেননা, ইমানের পরিণাম হচ্ছে ধৈর্য, সহনশীলতা ও অল্পে তুষ্ট থাকা। আর লোভ-লালসার পরিণাম হচ্ছে অশান্তি, ধৈর্যহীনতা ও অস্বস্তিবোধ।’ (সুনান নাসাঈ ও তিরমিজি)
একারণেই সূফীরা নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন এবং এখনও রাখেন। কেননা, নিজেক জাহির করা, নিজের সম্মান বৃদ্ধির লোভও অত্যন্ত ক্ষতিকর। এছাড়াও সূফীরা কখনোই কারো সরাসরি প্রশংসা করতেন না। বর্তমানে এর বেশ প্রচলন দেখা যায়। মানুষ অর্থের লোভে, ক্ষমতার লোভে, বিদপকে দূর করতে, সামনা সামনি প্রশংসা করার মত জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক লোককে অপর লোকের অতিরিক্ত প্রশংসা করতে শুনলেন। তারপর তিনি বললেন, তুমি তো ঐ লোকের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে (ধ্বংস করে দিয়েছ)। (সহীহ মুসলিম; ইফাবা: ৭২৩২)
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা অতিমাত্রায় প্রশংসাকারীদেরকে দেখলে তাদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করবে। (সহীহ মুসলিম-শামেলা:৩০০২)
এই কাজ গুলো নফসে আম্মারাকে খুশি করে। যার জন্যই সূফীরা এই ব্যাপারগুলো কঠোর ভাবে বর্জন করেছেন। শয়তান সর্বদা মানুষের ক্বলবে বসে বসে এই কাজগুলো করতে উৎসাহ প্রদান করে। বাহ্যিকভাবে এইকাজগুলো ভালো দেখালেও ধীরে ধীরে এগুলো মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের রক্ত চলাচলের স্থানে চলাচল করে। আর অবশ্যই আমি আশংকা করছি যে, শয়তান তোমাদের অন্তরে কোন খারাপ বস্ত ঢেলে দেয়। (সহীহ বুখারী; ২য় খন্ড; ৯১৮ পৃ)
অন্যত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই শয়তান স্বীয় শুড়কে আদম সন্তানের ক্বলবের মধ্যে রেখে দেয়। অতঃপর বান্দার ক্বলব যখন আল্লাহর যিকির করে তখন শয়তান পিছনে হটে যায়। আর যদি যিকির ভুলে যায় তখন সে বান্দার ক্বলবে গিলে ফেলে। (ইমাম বায়হাক্বী রহ. হাদীসটি উল্লেখ করেন)
ক্বলব মানে অন্তর নয়। আরবীতে صدور শব্দের অর্থ হচ্ছে অন্তর, মন, বুক। ক্বলব শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরার নাম। অপর হাদীসে এসেছে শয়তান ক্বলবের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে এবং ওয়াসওয়াসা দেয়।
ক্বলব কি? যিকির থেকে গাফেল হলেই শয়তানের ধোঁকা আকড়িয়ে ফেলে। কিন্তু একজন মানুষ কিভাবে সারাক্ষণ আল্লাহর জিকির করবে? এখানেই সূফীজমের সূচনা।
ক্বলবের জিকির কি, কিভাবে করে, মুখে জিকির আর ক্বলবি জিকিরের পার্থক্য কি? শয়তান আরো কিভাবে এবং কত রকমের পদ্ধতিতে ধোঁকা দেয়। ইত্যাদী বিস্তারিত ধারাবাহিকভাবে আসবে। ইনশাআল্লাহ।
চলবে………..
সূফীদের হালচাল। পর্ব-০৫ (1444)